Rose Good Luckভালবাসার সাতকাহন (ধারাবাহিক গল্পঃ পর্ব-৮) Rose Good Luck

লিখেছেন লিখেছেন মামুন ২০ অক্টোবর, ২০১৪, ০৫:৩০:৫৮ বিকাল



গত পাঁচটা দিন প্রচন্ড মানসিক কষ্টে কেটেছে শিহাবের।

সেই শনিবার বাসা থেকে এসেছে। আজ বৃহস্পতিবার। রাতে সবার সাথে দেখা হবে। কিন্তু সেদিনের ঝগড়ার পরে, কয়েকবার কণার সাথে কথা বলেছে। কেমন যেন আলগা আলগা মনে হল কণাকে শিহাবের কাছে। মেয়েদের কথাই মূলতঃ জিজ্ঞেস করেছে। গতকাল বিকেলে একবার ফোন করেছিল। তখন শিহাব জানতে চেয়েছিল, ' কেমন আছ তুমি?' উত্তরে কণা যা জানাল তাতে মনটা আরো খারাপ হল শিহাবের, ' আমি কেমন আছি জেনে কি করবে তুমি?' এভাবে কেন বলল কণা?

অফিসের কাজগুলো কেমন এলোমেলো হতে থাকলো। মনের শান্তি না থাকলে কি আর অন্য কাজগুলোও ভালোভাবে করা যায়। আর একজন মানুষের পরিবার হল সেই মনের নিয়ন্ত্রক। ভালো-মন্দ- এই দুই অবস্থার জন্য নিজের পারিবারিক জীবনে নিজের কর্মকান্ড কতটা সেই পরিবেশকে স্থিতিশীল রাখতে পারে, তার উপর নির্ভরশীল। শিহাব নিজের রাগকে নিয়ন্ত্রণ রাখতে না পারাতেই এই সপ্তাহব্যাপী মানসিক যাতনাকে সে নিজেই টেনে আনল। তবে কণার কি একটুও দোষ ছিল না?

নিজের কেবিনে বসে আছে শিহাব। এই ভাবনাটা আসাতেই নিজেকে চোখ রাঙ্গালো নিজেই। মনে মনে বলল, 'ব্যাটা এখনো তোর শিক্ষা হয় নাই, কিভাবে আজ বাসায় গিয়ে সব ঠিক করবি সেটাই ভাব। উল্টা কণার কি দোষ সেগুলো না ভেবে নিজে কেন করলি সেটাই ভাবতে থাক।' এবার একটু কেন জানি মনটা ভালো লাগছে। তারমানে কণাকে নির্দোষ ভাবাতেই ওর অবচেতন মন শান্তি পেয়েছে? যদিও কণার কাটা কাটা কথা এবং মেয়েলি 'নাই নাই কিংবা তু তু ম্যায় ম্যায়' দ্বারাই সে সেদিন তর্কযুদ্ধে নেমে পড়তে বাধ্য হয়েছিল। তবে ঠিক এই মুহুর্তে সে সম্পুর্ণ দোষ নিজের ঘাড়ে নিয়ে নিলো। এবং কণাকে সকল দোষ থেকে মুক্তি দিলো।

আর সাথে সাথেই হৃদয়ে এক অনাবিল প্রশান্তি অনুভব করল।

এটা কণার জন্য ওর ভালোবাসা নয়ত কি?

এই ভালোবাসা রয়ে গেছে বলেই সে এই ক'দিন কষ্ট পেয়েছে!

যাকে যতটুকু ভালোবাসা যায়, তার প্রতি রাগও কিন্তু সমপরিমাণেই করে মানুষ। রাগগুলো কিভাবে যেন এসে যায়।

কিন্তু বোকা মেয়েগুলো সেটা কেন বোঝে না?

অহেতুক গাল ফুলিয়ে থাকে। কথার বাণ নিক্ষেপ করে মজা পায়।

এই যেমন ওদের এবারের গন্ডগোলের তৃতীয় দিনে [ দুজনের ঝগড়া শুরু হয়েছিল বৃহস্পতিবার রাতে। সেটাকে 'গন্ডগোল নামেই ধরে নেয়া হল। এবারের দ্বারা বোঝা যায়, এরকম গন্ডগোল আরো হয়েছে।] শিহাব বেশ কয়েকবার কণাকে ফোন করে। কিন্তু কণা ফোন ধরে না। ঘন্টাখানেক পরে আবারো ফোন করলে এবার রিসিভ করে। শিহাব জানতে চায়,' কি ব্যাপার? ফোন ধরলে না যে?' উত্তরে কণা বলে, ' আমার সময় নেই।'

এটা একটা কথা হল?

ওর সাথে কথা বলার সময় যদি ওর না থাকে, তবে কার সাথে কথা বলার সময় রয়েছে? অন্য সময় হলে হয়তো এটা নিয়েই আমার তুমুল হয়ে যেতো।

এটাই কি জীবন? মুহুর্তেই ভালোবাসা হৃদয়কে তাড়িত করে বেড়ায়, পরক্ষণেই জন্ম নেয় সন্দেহ, অবিশ্বাস আর ঘৃণা! এগুওলো কি একই হৃদয়ে সব হাত ধরাধরি করে চলে? না হলে পরিস্থিতির চাপে পড়ে এর যে কোনো একটি জন্ম নেবার সাথে সাথেই কেন মানুষ প্রতিক্রিয়া দেখায়? যদি এমন হতো, রাগ থাকবে মানুষের হৃদয় থেকে ৫০০ মাইল দূরে, ঘৃণা থাকবে ১৪০০ মাইল দূরে, শুধু ভালোবাসা থাকবে হৃদয়ের অন্তঃস্থলে। তাহলে মানুষের যখন রাগ উঠবে, সে ৫০০ মাইল দূর থেকে আসতে আসতে ইতোমধ্যে ভালোবাসা পুরো হৃদয়কে দখল করে নিবে। আর রাগ এসে অধোমুখে ফিরে যাবে। ইস! কতই না ভালো হতো!

নিজের মনে এগুলো ভেবে ভেবে হাসতে থাকে শিহাব। কি সব উল্টাপাল্টা বাচ্চাদের মত ভেবে চলছে সে। কণার রাগ ভাঙ্গানোর জন্য তার এক বিশেষ প্ল্যান করা আছে। কাজটা শনিবারেই সে করে এসেছে। আজ বাসায় ফিরবার সময়ে শুধু এক যায়গায় কিছুক্ষণের যাত্রা বিরতি করলেই চলবে। অবশ্য এই রাগ ভাঙ্গানোর জন্য শিহাবের দীর্ঘদিনের একটি লালিত স্বপ্নের সাময়িক মৃত্যু হবে।

তা হোক না। ওর একটি স্বপ্নের মারা যাওয়াতে কণার স্বপ্নগুলো যদি দীর্ঘজীবী হয়, সেটাই কি ভালো নয়? কণা কি শুধুই একজন নারী? সে একজন মা ও বটে। যে শিহাবের অনুপস্থিতিতে পুরো সংসারটি দেখেশুনে পরম মমতায় আগলে রাখছে।

এই পৃথিবীর সকল মায়েরাই এমন!

মমতায় আশেপাশের সবাইকে ঘিরে রাখেন!

নিজের মায়ের কথা মনে পরে দু'চোখ অশ্রুসজল হয়ে পড়ে। ওর ভাবনায় কণা, মা, দুই কন্যা- এরা সকলে এক হয়ে যায়। এদের সমন্বিত একটি রূপ শিহাবকে যেন বলে,' যারা তোমাকে এমন মমতায়, স্নেহে, আদর-ভালোবাসায় জড়িয়ে রাখে, কেন তাদের সাথে এমন ব্যবহার কর?'

... .... ....

সকাল থেকেই কণাকে একটু কেমন যেন দেখে ওদের বড় মেয়ে ইসরাত। গত বৃহস্পতিবার থেকে বাবা-মায়ের ভিতরে ঘটে যাওয়া সেই অনাকাংখিত ঘটনাটি কণা এবং শিহাবের দুই মেয়ের মনোজগতেও আলোড়ন তুলেছে। ছোট মেয়ে রাইসা সেদিন রাতে খুব ভয় পেয়েছিল। সাধারণত ওদের বাবা-মায়ের ভিতর এরকম ঝগড়া দেখে বা শুনে ওরা অভ্যস্ত নয়। রাইসা ওর স্কুলে যাবার সময় পথের পাশে কাজের বুয়াদের বাসা অতিক্রম করে যায়। এই গরীব মানুষগুলো তাদের প্রতিদিনের জীবনে না পাওয়া এবং বঞ্চনার কষাঘাতে নিজেদের হৃদয়ের বেদনাগুলোকে মুখের কর্কশ ভাষায় উগড়ে দিতে চায়। আর রাইসা কখনো কখনো সেই সময়গুলোতে মায়ের হাত ধরে স্কুলে যায় এবং ওদের সেই ঝগড়া শুনতে পায়। যদিও ওদের ব্যবহার করা অনেক শব্দের মানেই সে বুঝে না। কিন্তু সেদিন রাতে বাবার মুখে ওগুলোর ভিতর থেকে দু'একটি শব্দ শুনে সে কিছুটা হতবাক হয়ে গেছে। কেননা অনেক দিন আগে কণাকে সে এই শব্দগুলোর ভিতর থেকে দু'একটি সে যা মনে রাখতে পেরেছিল, সেগুলোর অর্থ জিজ্ঞেস করেছিল। কণা ওকে এগুলো খুব খারাপ কথা, এসব শুনবেও না, আর বলবে ও না, বলেছিল সেদিন। তাই ওর কচি মনে এই প্রশ্নটি-ই জাগে, 'আমার পাপা কি খারাপ মানুষ ? সে কেন আম্মুকে এসব কথা বলবে?'

কণা গতকাল বিকেলে সাভারে গিয়েছিল। সাংসারিক কিছু কেনাকাটার প্রয়োজন ছিল। সেগুলোর সাথে আরো একটি কাজ করে এসেছে। সেটা ভেবেই একদিক দিয়ে মনের গভীরে আনন্দ পাচ্ছে। আবার একজন মেয়ে হবার কিছু স্বতঃসিদ্ধ নিয়মের বেড়াজালে পড়াতে একটু একটু কষ্টও পাচ্ছে। তবে সব কিছু মিলিয়ে নিজেকে বেশ উত্তেজিত মনে হচ্ছে। আর ওর বড় মেয়ে ইসরাত ঠিক এই জিনিসটি-ই লক্ষ্য করেছে। ওদের আম্মু কেন জানি ভিতরে ভিতরে খুব খুশী! সেটা কি আজ বৃহস্পতিবার বলে?

আজ বাবার আসার দিন বলে?

কিন্তু ওদের ভিতরে না ঝগড়া হয়েছে। সে নিজের রুমে বসে বসেও এই ক'দিন মোবাইলে ওদের বাবার সাথে কণার কথার কিছুটা শুনেছে। কিছুটা এই জন্য যে, শুধুমাত্র এই পাশের কথাই শুনতে পেয়েছে। আর সেখানে আম্মু কিভাবে বাবার সাথে কথা বলেছে, সেটা শুনে বাবার জন্য একটু খারাপ লেগেছিল।

আম্মু কেন এভাবে বাবার সাথে কথা বলল?

সে কি একটু নমনীয় হতে পারত না? সামনে ওর পরীক্ষা। জীবনের প্রথম বড় পরীক্ষা। অথচ ওদের বড় মানুষ দু'জনের এই ছেলেমানুষি কাজের দরুন ইসরাতের পড়ালেখার যে ক্ষতি হচ্ছে সেটা কি ওরা দু'জন বুঝতে পারছে?

ইসরাত নামের একটি মেয়ে যে তার বয়ঃসন্ধিকালীন অনুভূতিতে নিজের ভিতরে ভিতরে অস্থির এবং বিচলিত ছিল, বাবা-মায়ের ভিতরকার সম্পর্কের ভিতরের সম্পর্কহীনতা দেখে সে নিজের ছোট্ট জগতে আরো বেশী ম্রিয়মান হয়ে পড়ে।

বিকেলবেলা কণা খুব সুন্দরভাবে সাজে। বড় মেয়ের অবাক বিস্মিত দৃষ্টির সামনে সে নিজের কাজ করেই যেতে থাকে। মেয়ের ভ্রু একটু উঁচুতে উঠে গেলেও কণা নির্বিকার থাকে।

এরপর কিচেনে ব্যস্ত সময় কাটে কণার। নিজের হাতে সব কাজ করে অভ্যস্ত সে। বেশ কয়েকটি খাবার আইটেম বানাবার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। দুই মেয়ে এসে কয়েকবার ঘুরে গেছে। প্রতিটি আইটেম ওদের বাবার প্রিয়। ছোটজন তো একবার জিজ্ঞেস ই করে ফেললো, ' পাপার প্রিয় খাবারগুলো কেন বানাচ্ছ আম্মু?' বড়জন ফোড়ন কাটে মাঝখান থেকে, ' পাপার জন্য বানাচ্ছে না। অন্য কেউ আসবে মনে হয়। কে আসবে আম্মু?' অন্য সময় হলে মেয়েকে ইচ্ছেমত কথা শোনাতো কিংবা এটুকু তো বলতই, 'বেশী পাকামো হচ্ছে, না? কিন্তু আজ কণা ওদেরকে কিছুই বলল না। নীরবে নিজের কাজ করে চলল।

দুই মেয়ে ওদের মায়ের এমন নির্লীপ্ত ব্যবহারে বেশ অবাক হয়।

শিহাব এসে যখন বাসার কলিং বেল বাজায়, তখন রাত আটটা বেজে গেছে। ছোট মেয়ে রাইসা এসে দরোজা খুলে ওর পাপাকে দেখে প্রতিবারের মত আনন্দে উৎফুল্ল হয়ে মায়ের কাছে চলে যায়, 'আম্মু পাপা, পাপা...'। বরাবরের মত কণা বলে না, ' তো কি করব? নাচব?' আজ ছোট্ট করে শুধু বলে ,' ঠিক আছে।' স্বাভাবিক উত্তর না পেয়ে কেন জানি রাইসার মনটা ব্যথিত হয়। সে নিজের কাজে ফিরে যায়। কাজ বলতে এতোক্ষণ কার্টুন চ্যানেলে কার্টুন দেখছিল, সেখানেই ফিরে গেল।

শিহাব দরোজা থেকে মা-মেয়ের কথা শুনতে পায়। দরোজা বন্ধ করে জুতোর স্ট্যান্ডে জুতো রেখে কাঁধের ব্যাগটা নিয়ে বড় মেয়ের রুমে গেল। সে তখন পড়ছে। পাশের সোফায় ব্যাগটা রাখে মেয়ের হালচাল জিজ্ঞেস করে। অন্য সময়গুলোতে শিহাব বাসায় এসেই নিজেদের রুমে চলে যায়। আজ কি এক অজানা জড়তা ওকে মেয়ের রুমে টেনে নিয়ে এলো। মেয়েকে জিজ্ঞেস করল, ' তোমার আম্মুর কি অবস্থা? এখনো রাগ?'

মেয়ে নিজের বাবার দিকে তাকায়। একটু হাসে। বলে, ' রাগ তো হবেই। তুমি ওরকম করেছিলে কেন? যাও এখন মানাও গিয়ে।'

শিহাবও হাসে। হাসির সাথে নিজের ভিতরের সকল দ্বিধা -দ্বন্দ্ব গুলোকে উড়িয়ে দিয়ে চায়।

কিন্তু এতো সহজেই কি সব কিছু হেসে উড়িয়ে দেয়া যায়?

কণা নিজেদের বেডরুমে বসে আছে। অন্যান্য বৃহস্পতিবার গুলোতে কলিং বেলের আওয়াজ পেয়ে রাইসা যখন দরোজা খুলে দিয়ে ওর পাপাকে দেখে ওর কাছে ফিরে আসে, নিজের বসা অবস্থান থেকে উঠে কণা দরোজার দিকে এগিয়ে যায়। ভ্রমণক্লান্ত শিহাবকে একনজর দেখে... আনন্দ পায়! আজও রাইসা একইভাবে ওর কাছে আসল... কিন্তু নিজের ভিতরে একটা জড়তা কেন জানি ওকে ওর বসা যায়গা থেকে উঠতে দিলো না। আর বরাবরের মত শিহাবও ওর কাছে এলোনা দেখে মনটা আরো খারাপ হল। ভাবল, কি হতো আসলে?

অথচ নিজে যে ওর কাছে যেতে পারত, সেটা বেমালুম ভুলে গেলো।

শিহাব ফ্রেস হয়... নিজের ঘরোয়া পোষাকে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে। ওদের বেডরুমেই টেলিভিশন রাখা। সেখানে ছোট মেয়ে রাইসাকে নিয়ে কিছুক্ষণ কার্টুন চ্যানেলে টম এন্ড জেরি দেখে। বাবা-মেয়েতে কিছুক্ষণ পরপর হেসে গড়িয়ে পড়ে। খাটের এক পাশে বসে কণা দেখে আর ভিতরে ভিতরে জ্বলতে থাকে। এতো হাসির কি হল সে ভেবে পায় না। সেও তো দেখছে, কই, তার তো হাসি আসছে না। একবার নিজের মনে নিজেকে জিজ্ঞেস করে, ' আসলেই কি তুমি দেখছ? তোমার মন কি এখানে রয়েছে?'

বেশ কিছুক্ষণ পর কণা রাইসাকে ডাকে।

ওর সাহায্য নিয়ে ভাববাচ্যে কথা বলে,

: তোমার বাবাকে জিজ্ঞেস কর খাবে কিনা?

শিহাব কণার দিকে না তাকিয়ে রাইসাকে উত্তর দেয়,

: আম্মুকে খাবার দিতে বল।

মেয়ে একবার বাবার দিকে তাকায়। পরক্ষণেই মাকে দেখে।

বড় মানুষগুলোর এই ছেলেমানুষি দেখে সে মনে মনে হাসে। ওর চেহারায়ও সেটা প্রকাশ পায়। এরা যে কি!

অন্য সময়গুলোতে কণা নিজে এটা ওটা বেড়ে খাওয়াতো। শিহাব পছন্দের আইটেমটা দিয়ে আরো একটু ভাত বেশী খেতে চাইলে কপট রাগের অভিনয় করত। শিহাব মুটিয়ে যাচ্ছে, সেটা মনে করিয়ে দিতো। এরকম মৃদু খুনসুটিতে শিহাব-কণার দুই মেয়েকে নিয়ে সপ্তাহের এই বিশেষ রাতটি কত আনন্দে কেটে যেতো! আজ সেরকম কিছুই নেই... নেই কোনো কপট অভিনয় কিংবা খাবার দেখে শিহাবের লোভী হয়ে উঠবার মিছে ছল। আজ দুজনেই কেন জানি অতিরিক্ত ভাব-গাম্ভীর্যের সাথে এক একজন জেন্টেলম্যান/ওম্যান হয়ে উঠে।

দুই মেয়ে ঘুমিয়ে গেছে। বড় মেয়ে নিজের আলাদা রুমে ঘুমায়। ছোট মেয়ে এখনো মাকে পাশে না নিয়ে ঘুমাতে পারে না। বাবা-মায়ের মাঝখানে তার স্থান নির্ধারিত। দুই পা দুজনের শরীরে না রাখলে সেও ঘুমাতে পারে না। তবে সপ্তাহের অন্য দিনগুলোতে সে কি করে শিহাবের বড্ড জানতে ইছে করে।

রাইসা ঘুমিয়ে গেলে শিহাব বিছানা থেকে নামে। কণার দিকে তাকায়। নাহ, সে এখনো ঘুমায় নাই। নিজের ব্যাগের ভিতর থেকে র‍্যাপিং পেপারে মড়া একটা প্যাকেট বের করে। কণাকে ডাকে,

: অ্যাই, ঘুমাইছ?

প্রথমটায় কণা না শোনার ভান করে। মেয়েরা এমনই হয়। অতিরিক্ত ঢং আর দেখানোর প্রবণতা ওদের ভিতরে থাকবেই। শিহাব এগুলো মনে মনে ভাবে। কিন্তু বিরক্ত হয় না। আসলে কনার এই সব ঢং ওর কাছে বেশ লাগে। অন্যদের কাছে লাগে কিনা সে জানে না। তবে জানতে হবে।

আবারো ডাকে। এবার কণা পাশ ফিরে ওর দিকে তাকায়। বলে,

: কি হইছে? বিরক্ত করছ কেন?

: আরে ওঠোই না। এদিকে আসো।

কেমন এক মন্ত্রমুগ্ধের মত কণা বিছান থেকে নামে... শিহাবের পাশে আসে। শিহাব শেইভ করেছে... পরিচিত আফটার শেইভ লোশনের ঘ্রাণে মনটা কেমন যেন হয়ে যায় কণার। নিজের ভিতর থেকে কে যেন ওকে বলে, 'খবরদার, দুর্বল হলে চলবে না। শক্ত থাক। তোমাকে হারলে চলবে না।' তবে কণা এই প্রথমবার নিজের মনের ভিতরের ডাককে অগ্রাহ্য করতে চায়। ওর কাছে মনে হয়, এটা কুডাক। শয়তানের প্ররোচনা। সে শিহাবের আরো কাছে চলে আসে।

ওর চোখে চোখ রাখে... শিহাব প্যাকেটটি ড্রেসিং টেবিলের উপর রাখে। কণার চিবুকটিকে উচিয়ে ধরে ওর চোখে চোখ রাখে... নিজের ভিতরের সকল গ্লানিকে অনুভব করে এবং অনুতপ্ত হয়ে বলে,

: স্যরি!

একটি ইংরেজি শব্দ। কিন্ত এর ভিতরে কত কিছু যে লুকিয়ে থাকে! অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে এই একই শব্দ এক একভাবে অর্থবহন করে। আচ্ছা, শিহাব স্যরি না বলে 'আমি দুঃখিত' বললে কি এরকম লাগত? এতটা ভালোলাগার অনুরণন বেজে উঠত হৃদয়ে?

: আমিও স্যরি!

কণার কথায় একটা পাষাণভার নেমে যায় শিহাবের হৃদয় থেকে। র‍্যাপিং পেপারে মোড়া প্যাকেটটাকে কণার হাতে দেয়। বলে, 'তোমার জন্য গিফট।'

: কি আছে এতে?

: খুলেই দেখ।

কণা দ্রুত হাতে প্যাকেটের র‍্যাপিং খোলে। ভিতরে একটি নেকলেস বক্স। একটু অবাক হয়ে ডালাটি খুলতেই চমকে উঠে। একটি নেকলেস। ওর হাতের বালাগুলোর ডিজাইনের সাথে মিলিয়ে বানানো হয়েছে। প্রচন্ড একটা আনন্দ হৃদয়ের তন্ত্রীতে তন্ত্রীতে বয়ে যায় মুহুর্তে! কিন্তু সেটা হার পাবার আনন্দে নয়। শিহাব এই ডিজাইন এক সপ্তাহে মনে হয় না করেছে। ওর মনে আগে থেকেই এটার পরিকল্পনা ছিল। তার মানে কণাকে নিয়ে শিহাব ভাবে... ওর জন্য অনেক কিছু করার জন্য চিন্তা-ভাবনায় সময় কাটায়। নিজেকে অনেক ছোট মনে হয় কণার কাছে। আর সে কিনা সেদিন এই সামান্য একটি গহনার জন্য ঝগড়ার সুত্রপাত করেছিল।

অন্য একটি চিন্তা মনে আসতেই নিজেকে সামলে কণা জিজ্ঞেস করে,

: এতো টাকা পেলে কোথায় তুমি?

শিহাব একমুহুর্ত থমকে যায়। আসল উত্তরটি এইমুহুর্তে দিতে ইচ্ছে করছে না ওর। তবে মিথ্যেও বলবে না ঠিক করেছে। স্বামী- স্ত্রীর ভিতরে কখনোই এই মিথ্যেকে আনা উচিত নয়। জীবনের যে কোনো পর্যায়েই যে কারো সাথেই এই জঘন্য কাজটিকে টেনে আনা উচিত নয়।

: আমার একাউন্ট থেকে সব তুলে ফেলেছি।

অবাক হয় কণা। বলে,

: সব? মানে ওগুলো তো তুমি মটর বাইক কেনার জন্য জমাচ্ছিলে?

: হ্যা, তো কি হয়েছে? আবার জমবে... জমাবো ইনশা আল্লাহ।

কণার পায়ের নীচ থেকে মনে হয় মাটি সরে গেলো। ওর মুখ শুকিয়ে প্রচন্ড একটা কষ্টের আবহ নিমিষে সাড়া দেহমনকে কাঁপিয়ে দিয়ে যায়। চোখের দু'কোন বেয়ে পানি বয়ে যেতে থাকে।

শিহাব প্রথমটায় অবাক হয়। কিন্তু কনার এক্সপ্রেশন দেখে একটু ভয়ও পেয়ে যায়। ভাবে না জানি আবার কি ভুল করে ফেলেছে সে। ডুকরে কেঁদে উঠে কণা। শিহাব ওকে ধরে ড্রেসিং টেবিলের টুলে বসায়। নিজেও মেঝেতে হাঁটু গেঁড়ে বসে। বলে,

: কি হয়েছে? তুমি এমন করছ কেন?

কণা একটু ধাতস্থ হবার চেষ্টা করে। এরপর নিজের পার্সটা ওয়ারড্রোবের উপর থেকে শিহাবকে দিতে বলে। সেটা হাতে পেয়ে কণা পার্সের চেইন খুলে ভিতর থেকে একটা মোটা খাম বের করে। সেটা শিহাবের হাতে দিলে শিহাব জিজ্ঞেস করে,

: কি আছে এর ভিতরে?

: খুলেই দেখ।

শিহাব কম্পিত হাতে খামটা খোলে। ভিতর থেকে অনেকগুলো এক হাজার টাকার নোট বের হয়ে আসে। কয়েকটি মেঝেতে পড়ে গেলে শিহাব সেগুলো তুলে হাতে নেয়।

: এগুলো কি? এতো টাকা কোত্থেকে এলো? - কণাকে জিজ্ঞেস করে।

: তোমার মটর বাইকের জন্য আমি আমার হাতের বালা দুটো বিক্রী করে দিয়েছি।

শিহাব প্রচন্ড এক কষ্ট পায়। এই কষ্টের ভিতরে কেমন এক ভালোলাগার অনুভূতিও পাক খেয়ে খেয়ে যেতে থাকে। কনাও ওকে নিয়ে ভাবে!

শিহাবের একটা মটর বাইকের স্বপ্ন। কণাও সেটা জানে। তিল তিল করে টাকা জমিয়ে চলেছে শিহাব। কিছু টাকা বাকী থাকাতে সেটা কিনতে পারছিল না, তাও কণার অজানা ছিল না। সেজন্যই সে নিজের প্রিয় সোনার বালা দুটি বিক্রী করে দিয়েছে।

শিহাব যাতে তার স্বপ্ন পূরণ করতে পারে সেজন্য।

প্রচন্ড একটা ঝড় বয়ে যায় শিহাবের বুকের ভিতরে। কিন্তু কণার মত সেখানে জোর বর্ষণ হয় না। বারিহীন এক প্রচন্ড ঝড়ে কাঁপতে কাঁপতে শিহাব কণাকে কাছে টেনে নেয়। ততোক্ষণে ঝড় শুরু হয়েছে ওদিকেও। দু'জন নারী-পুরুষ নিজ নিজ প্রিয় জিনিস কে উৎতসর্গ করে অন্যজনকে সুখী করতে চেয়েছে। কিন্তু জিনিসের উৎসর্গের থেকে আসল ব্যাপারটি হল নিজেদের ভিতরের বোঝাপরা এবং পারষ্পরিক সম্মান জানানোর মানসিকতা গড়ে উঠা। যেটা এই দু'জনের ভিতরে ঠিক এই মুহুর্তে গড়ে উঠেছে।

সকালবেলা রাইসাই সবার আগে উঠল।

ওকে মাঝখানে রেখে পাপা-আমু ঘুমিয়েছিল। ওর বেশ মনে আছে।

তবে রাতে ওকে মাঝখানে রেখে দু'জনে ঘুমালেও সকালবেলায় কিভাবে যেন দু'জনে পাশাপাশি কুন্ডলি পাকিয়ে ঘুমিয়ে রয়েছে। ঘুমন্ত এই দু'জনকে ওর বড্ড ভাল লাগছে। কত মায়া ওদের দু'জনের চেহারায় মিশে আছে।

এই সকালবেলায়ও বাবা-মাকে দেখতে দেখতে ওর কচি মনে সেই ভাবনাটি আবারো দোলা দিয়ে যায়- ' বড় মানুষগুলো আসলেই একদম বাবুদের মত। কত সহজেই এরা সব ভুলে যায়!' Good Luck Good Luck

(ক্রমশঃ)

বিষয়: সাহিত্য

১০৮১ বার পঠিত, ১১ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

276415
২০ অক্টোবর ২০১৪ সন্ধ্যা ০৬:২৫
রাইয়ান লিখেছেন : ও হেনরির ' গিফট অফ দ্য মেজাই ' এর ডেলা আর জিমের কথা মনে পড়ে গেল ..... Day Dreaming আর আপনার অনবদ্য নির্মান তো প্রশংসাতীত.... Thumbs Up Thumbs Up
২০ অক্টোবর ২০১৪ সন্ধ্যা ০৬:৫২
220373
মামুন লিখেছেন : হ্যা, লিখবার সময়ে ইন্টারে পড়া সেই জিম-ডেলা লিখতে লিখতে মনের ভিতরে চলে এসেছিল। ওদের ভিতরের মনোমালিন্য দূর করার জন্য গিফটের কথা মাথায় আসে। আর তখনি ঐ গল্পটির দু'জনের উৎসর্গের কথা মনে পড়ে। ডেলার চুল আর জিমের হাত ঘড়ির মত এখানেও শিহাবের মটরবাইকের জন্য জমানো টাকা এবং কণার জন্য একটি গহনা ক্রয় করতে এরা একে অপরের জন্য নিজ নিজ স্বপ্নকে ত্যাগ করে।
আপনাকে অনেক ধন্যবাদ সুন্দর মন্তব্য করাতে। আর চট করে আপনি ধরে ফেলুলেন জিম এবং ডেলার লিঙ্কটি! সেজন্যও অনেক ধন্যবাদ।
জাজাকাল্লাহু খাইর।Good Luck Good Luck
276419
২০ অক্টোবর ২০১৪ সন্ধ্যা ০৬:৫৪
মামুন লিখেছেন : স্যরি, একটি বানান ভুল করেছি ফেলুলেন এর যায়গায় হবে ফেললেন।
ধন্যবাদ। Good Luck
276436
২০ অক্টোবর ২০১৪ সন্ধ্যা ০৭:৫৫
সাদিয়া মুকিম লিখেছেন : আসসালামুআলাইকুম। Good Luck

নারী-পুরুষ চরিত্রগুলোর সুনিপুন বৈশিষ্ট্যের চমৎকার ধারাবাহিক পড়লাম!গিফটের ব্যাপারটায় এসে আমারো জিম আর ডেলার কথা পড়েছিলো! চমৎকার লিখনীর জন্য অসংখ্য অভিনন্দন Good Luck

জাযাকাল্লাহু খাইর Good Luck
২১ অক্টোবর ২০১৪ সকাল ০৭:৪৪
220578
মামুন লিখেছেন : ওয়ালাইকুম আসসালাম।
সুন্দর অনুভূতি রেখে যাবার এবং প্রেরণামূলক মন্তব্যের জন্য আপনাকেও অনেক ধন্যবাদ এবং শুভেচ্ছা।
জাজাকাল্লাহু খাইর।Good Luck Good Luck
276438
২০ অক্টোবর ২০১৪ সন্ধ্যা ০৭:৫৮
নিরবে লিখেছেন : ভালো লাগল। জিম আর ডেলার মতই ... Happy>- Happy>- Happy>- Happy>-
২১ অক্টোবর ২০১৪ সকাল ০৭:৪৫
220580
মামুন লিখেছেন : অনুভূতি রেখে যাবার জন্য অনেক অনেক ধন্যবাদ।
জাজাকাল্লাহু খাইর।Good Luck Good Luck
276493
২০ অক্টোবর ২০১৪ রাত ১০:০৫
আফরা লিখেছেন : হায় হায় ভাইয়া আপনি করেছেন কি সেই গল্পটাকে এনে এখানে জোড়া লাগিয়ে দিলেন কেন ?এই সকালবেলায়ও বাবা-মাকে দেখতে দেখতে ওর কচি মনে সেই ভাবনাটি আবারো দোলা দিয়ে যায় ।

এই লেখাটুকু পড়লে আমার চোখে পানি চলে আসে ।

তবু আপনাকে অনেক ধন্যবাদ ভাইয়া ।
২১ অক্টোবর ২০১৪ সকাল ০৭:৪৭
220581
মামুন লিখেছেন : আপনার চোখে পানি এসে যাবার জন্য আবার দুঃখিত।
অণুগল্পগুলো এক সময় বড় গল্পে পরীনত হয়। সেজন্যই এই লিখাটায় জুড়ে দেয়া। মূলতঃ এই অণুগল্পকে কেন্দ্র করেই প্লটটির প্রাথমিক চিন্তা-ভাবনা ছিল, তাই সেটিকে মন থেকে তাড়াতে পারিনি।
অনেক ধন্যবাদ অনুভূতি রেখে যাবার জন্য।
জাজাকাল্লাহু খাইর।Good Luck Good Luck
277217
২৩ অক্টোবর ২০১৪ রাত ০১:৫১
মাহবুবা সুলতানা লায়লা লিখেছেন : ভালো লাগা চিহ্ন রেখে গেলাম আপনার লেখনীতে.........।
২৩ অক্টোবর ২০১৪ সকাল ০৭:৩৫
221217
মামুন লিখেছেন : ধন্যবাদ ভালোলাগার চিহ্ন রেখে যাবার জন্য।
জাজাকাল্লাহু খাইর।Good Luck Good Luck

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File